সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:০৮ পূর্বাহ্ন
আখতারুজ্জামান আখতার, পাবনা ও পবিত্র তালুকদার, চাটমোহর, কালের খবর :
তিনি শুধু চিকিৎসকই নন, চিকিৎসকদের সংগঠন বিএমএ’র আজীবন সদস্য। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে পাবনা শহরসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে এক দশক ধরে চিকিৎসা বাণিজ্য করে চলেছেন দাপটের সঙ্গে।
সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ভুয়া প্রমাণিত হওয়ার পর এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন। বিষয়টি পাবনার চিকিৎসকদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।
ভুয়া এই চিকিৎসকের নাম মাসুদ করিম। তিনি অন্যের নাম এবং বিএমডিসির নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে ডাক্তার সেজে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলেন। বিষয়টি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রকাশ হলে কথিত ওই চিকিৎসক এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান।
জানা যায়, মাসুদ করিম পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার শরৎনগর বাজারে হেলথ কেয়ার লিমিটেড নামে একটি ক্লিনিকের আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে উচ্চ বেতনে কর্মরত ছিলেন। প্রকৃত চিকিৎসক মাসুদ করিম ঢাকার একটি ক্লিনিকে কর্মরত আছেন বলে জানা গেছে। এই নামটি ব্যবহার করেই প্রতারণা করে আসছিলেন ওই ভুয়া মাসুদ করিম।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, কথিত চিকিৎসক মাসুদ করিম ৮ বছর আগে ভাঙ্গুড়া হেলথ কেয়ার ক্লিনিক লিমিটেডে আলট্রাসনোলজিস্ট ও আবাসিক চিকিসক হিসেবে যোগ দেন। ক্লিনিক মালিক তার বেতন ধার্য করেন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা। এছাড়াও তিনি ল্যাবের কমিশন পান।
কথিত চিকিৎসক মাসুদ করিম বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর ৩৩৩৬০ ব্যবহার করে ক্লিনিকে রোগী দেখার পাশাপাশি আলট্রাসনোগ্রাম করতেন। সম্প্রতি সাঈদ মাহবুব উল কাদির নামে এক ব্যক্তি তার ফেসবুক আইডিতে মাসুদ করিমের প্রতারণা নিয়ে একটি স্ট্যাটাস দেন।
সেখানে তিনি ভুয়া ও প্রকৃত চিকিৎসকের ছবি দিয়ে লেখেন, ‘হেলথ কেয়ার লিমিটেড ক্লিনিকে বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর ৩৩৩৬০ ব্যবহার করে যিনি চিকিৎসা দিচ্ছেন তিনি প্রকৃত ডাক্তার নন। ঢাকার একটি ক্লিনিকে কর্মরত চিকিৎসক প্রকৃত মাসুদ করিমের নাম-পরিচয় ও নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে পাবনার ভাঙ্গুড়ায় চিকিৎসা দিচ্ছেন ভুয়া ডাক্তার মাসুদ করিম।’
বিষয়টি ভাইরাল হয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খাতুন অভিযুক্ত মাসুদ করিমের কাছে তার শিক্ষাজীবন ও বিএমডিসির সকল কাগজপত্র দেখতে চান। কাগজপত্র না দেখিয়ে ওইদিন রাতেই মাসুদ করিম ভাঙ্গুড়া ত্যাগ করেন।
এদিকে ঢাকার খিলগাঁও এলাকার প্রকৃত চিকিৎসক মাসুদ করিম ভাঙ্গুড়া উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খাতুন এবং পাবনার সিভিল সার্জন ডা. তাহাজ্জেল হোসেনের কাছে একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন।
এতে প্রকৃত চিকিৎসক মাসুদ করিম বলেন, আমি ২০০১ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করি। আমার বিএমডিসি নং এ-৩৩৩৬০। ঢাকার খিলগাঁওয়ে নিজস্ব চেম্বারে দীর্ঘদিন ধরে প্র্যাকটিস করে আসছি। সম্প্রতি জেনেছি আমার নাম-পরিচয় ও বিএমডিসি নিবন্ধন নম্বর ব্যবহার করে পাবনার ভাঙ্গুড়ায় একই নামে একজন ভুয়া চিকিৎসক সেজে ক্লিনিকে চাকরি করছেন। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিভিন্ন শাখায় মৌখিকভাবে জানিয়েছি। পাবনার সিভিল সার্জনকে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। তার বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করব।’
শুক্রবার সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত প্রকৃত চিকিৎসক মাসুদ করিম মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চেয়ে বৃহস্পতিবার কথিত চিকিৎসক মাসুদ করিমের মুঠোফোনে কল দিলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ১৯৯২-৯৩ সেশনে ভর্তি হয়েছিলাম। আমি ঢাকায় এসেছি। বিএমডিসিতে গিয়েছিলাম। তারা আমাকে নতুন করে কাগজপত্র ঠিক করে নিয়ে আসতে বলেছে। আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে যাচ্ছি।’
তিনি জানান, তার পৈতৃক বাড়ি ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলায়। তবে রংপুরের শালবন এলাকায় স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে আসছিলেন। তার বাবার নাম আবদুস সাকুর। শুক্রবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেননি।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা পরিবার ও পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খাতুন জানান, চিকিৎসক দাবিদার মাসুদ করিম মূল কাগজপত্র দেখাতে পারেননি। প্রকৃত মাসুদ করিম সশরীরে আমার কাছে এসে অভিযোগ দিয়েছেন। বিষয়টি সিভিল সার্জন স্যার, ইউএনও এবং বিএমডিসি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। কথিত মাসুদ করিম যে ভুয়া তা প্রাথমিকভাবে তাদের কাছে প্রমাণিত হয়েছে।’
ডা. হালিমা খাতুন আরও বলেন, ‘ইতিপূর্বে এই লোক পাবনায় বিভিন্ন ক্লিনিকে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করেছেন। আমার জানামতে বিএমএ’র নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এত দিন আমরা সে যে ভুয়া তা বুঝতে পারিনি। কাগজপত্র আনার কথা বলে মূলত সে পালিয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। আমরা আইনের বিষয়টি প্রশাসনকেও জানিয়েছি।’
অভিযুক্ত মাসুদ করিমের বিষয়ে হেলথ কেয়ার লিমিটেড ক্লিনিকের পরিচালক আবদুল জব্বার জানান, মাসুদ করিম মাসিক ১ লাখ ১৫ হাজার টাকা বেতনে আমাদের ক্লিনিকে চাকরি করে আসছেন। তিনি পাবনা জেলা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) আজীবন সদস্য। পাবনার বিভিন্ন ক্লিনিকে দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন। আমাদের কাছে তার সনদের ফটোকপি জমা দিয়েছিলেন। তবে এখন শুনছি তিনি ভুয়া চিকিৎসক।
পাবনা বিএমএ’র সাধারণ সম্পাদক ডা. আনন জানান, কথিত ডা. মাসুদ করিম ২০১২ সালের দিকে প্রকৃত ডাক্তারের বিএমডিসি (পরিচয়পত্র) দিয়ে পাবনা বিএমএ’র আজীবন সদস্য হন। তিনি যে ভুয়া, তা জানাজানি হলে তিনি পালিয়ে গেছেন।
এ প্রসঙ্গে পাবনার সিভিল সার্জন ডাক্তার তাহাজ্জেল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার হালিমা খাতুনকে বলেছি।